আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সকল স্থল ও বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে স্থল ও বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগিতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে একযোগে কাজ করবে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রটোকল বজায় রাখতে এই ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরে দেশের সীমান্ত এলাকার সকল স্থল বন্দরসমূহ বিশেষকরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থল বন্দরগুলো চিহ্নিত করে কঠোর নজরদারীর আওতায় আনা হচ্ছে। যাতে করে এসময়ের মধ্যে দেশ এবং দেশের বাইরের কোন রাজনৈতিক দুষ্টচক্র বাংলাদেশে ঢুঁকে কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার সৃষ্টি করতে না পারে এবং সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে মানবপাচার এবং অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব হয়।

বাংলাদেশের প্রধান স্থলবন্দর- বেনাপোল আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সকল স্থল বন্দরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। তবে স্থলবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধিন বাংলাদেশ পুলিশের কয়েকটি বিশেষ সংস্থা যৌথভাবে কাজ করে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের ২৪টি স্থলবন্দর রয়েছে। ভারতের সাথে ২৩টি (এর মধ্যে ভারতের ৫টি রাজ্যের সংযোগ রয়েছে) এবং মিয়ানমারের সাথে ১টি (টেকনাফ) স্থলবন্দর রয়েছে। ভারত লাগোয়া বাংলাদেশের ১৬টি বন্দর দিয়ে মালামাল আমদানি-রপ্তানি ও যাত্রী পারাপার বেশি হয়। এগুলো হলো- দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরা (সাতক্ষীরা), বুড়িমারী (লালমনিরহাট), আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সোনামসজিদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), হিলি (দিনাজপুর), বাংলাবান্ধা (পঞ্চগড়), তামাবিল (সিলেট), বিবিরবাজার (কুমিল্লা), সোনাহাট (কুড়িগ্রাম), নাকুগাঁও (শেরপুর), বিলোনিয়া (ফেনি), শেওলা (সিলেট), ধানুয়া কামালপুর (জামালপুর) এবং ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রধান বন্দর টেকনাফ (কক্সবাজার)।

এদিকে, ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এই ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ এভসেক (AVSEC) বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। তবে, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েকটি সংস্থা যৌথভাবে কাজ করে থাকে।

উল্লেখ্য, গত ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে পুরো বিমানবন্দর এলাকাকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছিলো। এসময় বিমানবন্দরের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে রানওয়ে পর্যন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যৌথভাবে কাজ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ এভসেক (AVSEC), বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), র‍্যাব এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

নির্বাচনী তপসীল ঘোষনার পর বিমান বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালকের (এয়ারওয়ার্দিনেস এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং) দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে, নাম না প্রকাশ করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রেস এজেন্সি, প্রেসেঞ্জা’কে জানান- আমরা এখন পর্যন্ত এমন কোন নির্দেশনা হাতে পাইনি। তবে নির্বাচনের আগে এবং পরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা বিবেচনায় রেখে বিমান বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে যাত্রী ব্যতীত সব ধরনের সহযাত্রী এবং দর্শনার্থীর প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টি আবারও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং বিমান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকায় ড্রোন উড্ডয়ন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিমান বন্দরে সার্বক্ষণিক সিসিটিভি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কন্ট্রোল রুম থেকে সন্দেহভাজন গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে জানা গেছে- যাত্রীদের হয়রানি কমাতে এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আগমন ও বহির্গমন টার্মিনালে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের পাশাপাশি এখন থেকে ভিআইপি এবং ভিভিআইপিদের লাগেজও কঠোরভাবে স্ক্যানিং করা হচ্ছে। হাই-রিস্ক ব্যাগেজগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ম্যানুয়াল চেক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিমানবন্দরে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি এবং যথাযথ রেকর্ড রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যাত্রীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ- লাগেজ কাটা বা মালামাল চুরির ঘটনা বন্ধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করা হয়েছে।

এদিকে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জাতীয় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের লাগেজ ওঠানামায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বডি-ওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার শুরু করেছে। এর ফলে লাগেজ হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরেছে এবং কোনো অনিয়ম হলে সহজেই শনাক্ত করা যাচ্ছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টার বৃদ্ধি এবং জনবল পুনর্বিন্যাসের ফলে যাত্রীদের লাগেজ পেতে আগের চেয়ে কম সময় লাগছে।

ইতোমধ্যে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তৎপরতায় বিমানবন্দরে দালালি, অতিরিক্ত মূল্য আদায় এবং যাত্রী হয়রানি রোধে বিমানবন্দরে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। যেকোনো অভিযোগ বা জরুরি তথ্যের জন্য বিমানবন্দরের হটলাইন নম্বর এবং যাত্রীদের জন্য পরামর্শ/সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ জানান, ইমিগ্রেশন কাউন্টার বৃদ্ধি, আধুনিক স্ক্যানিং মেশিন স্থাপন এবং জনবল পুনর্বিন্যাসের ফলে যাত্রীদের অপেক্ষার সময় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বসার সুব্যবস্থা বাড়িয়ে টার্মিনাল এলাকাকে আরও পরিবেশবান্ধব করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার মান আরও এক ধাপ এগিয়ে নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা এবং কঠোর নজরদারির ফলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীসেবায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে চেক-ইন ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ায় গতি আনা, ব্যাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের আধুনিকায়ন এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কঠোর তৎপরতায় সাধারণ যাত্রী ও প্রবাসীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।