দেখতে দেখতে ১৩ বছর পার হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি হত্যার। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পিছিয়েছে ১১৭ বার। আলোচিত এই হত্যার বিচারের দাবিতে এখনও আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন তাদের শোকাহত পরিবার। পুত্রবধু ও সন্তানের হত্যাকারীদের বিচারের অপেক্ষায় থাকা সাগরের মা রোগে-শোকে কাবু।
হত্যাকাণ্ডের সময় ৫ বছরের শিশু মেঘের বয়স এখন আঠারো। মেঘও দেখতে চান বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের বিচার। অন্যদিকে সাগর-রুনির সহকর্মী সাংবাদিকদের দাবি দ্রুত বিচারের। কিন্তু এত বছরেও কোনো গতি না আসায় সবার কণ্ঠে ক্ষোভের আগুন।
সবার অভিযোগ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিচারের আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবে রূপ পায়নি। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এই দলটির ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী মহল এই ঘটনায় জড়িত থাকায় বিচার কার্যাক্রম এতো বছর থমকে ছিলো বলেও অভিযোগ স্বজন, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্টদের।
তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাংবাদিক দম্পতি হত্যার বিচার নিয়ে শুরুতে তৎপরতা দেখা গেছে। র ্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন র ্যাবের কাছ থেকে মামলা দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এখনো কোনো বড় অগ্রগতির কথা জানাতে না পারলেও তারা গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করছেন। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
যেভাবে হত্যার শিকার সাংবাদিক দম্পতি
সাগর সরওয়ার মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক এবং তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানী ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় তাদের হত্যা করা হয়। তখন তাদের বাসায় ছিল একমাত্র সন্তান মাহির সরোয়ার মেঘ। যার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। হত্যার ঘটনায় ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শেরেবাংলা নগর থানায় জোড়া খুনের মামলা করেন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান। আজও সেই মামলা আলোর মুখ দেখেনি। বারবার পরিবর্তন হয়েছে তদন্তের লোকজন। দফায় দফায় শুধু পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়।
মামলার দায়িত্ব ডিবি-র ্যাবের হাত ঘুরে যেভাবে পিবিআইয়ের কাঁধে
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলার পর শেরেবাংলা নগর থানাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিন দিন পর ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে তদন্তকাজ হস্তান্তর করা হয়। ডিবি ওই বছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত তদন্তকাজ পরিচালনা করে। মামলাটি ২০১২ সালের এপ্রিলে র ্যাবের কাছে স্থানান্তরিত হয়। র ্যাব ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত তদন্ত পরিচালনা করে। ৪ নভেম্বর হাইকোর্টের আদেশে পিআইবি মামলার তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে। গত বছরের ২৩ অক্টোবর, মামলাটি তদন্তের জন্য চার সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয় যেখানে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধানকে আহ্বায়ক করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা হলেন পিবিআই এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক।
টাস্কফোর্সকে তদন্ত শেষ করে ছয় মাসের মধ্যে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও ইতিমধ্যে সেই সময় পার হয়ে গেছে।
এদিকে তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান ও আসামি হুমায়ুন কবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে পিবিআই। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন।
পিবিআই মামলার সঙ্গে জড়িত ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলে জানা গেছে।
এই হত্যাকাণ্ডের পর আট জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন— কামরুল ইসলাম ওরফে অরুণ, আবু সাঈদ, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, পলাশ রুদ্র পাল, আনামুল হক ওরফে হুমায়ুন কবির এবং তানভীর রহমান খান। তানভীর ও পলাশ বর্তমানে কারাগারের বাইরে ও অন্যরা কারাগারে আছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পিছিয়েছে ১১৮ বার
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গত এপ্রিলে ধার্যকৃত তারিখেও জমা পড়েনি। এ নিয়ে এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ ১১৮ বার পেছানো হয়েছে। নতুন তারিখ ২১ মে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন দিন ঠিক করেন ঢাকার সিএমএম আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এম এ আজহারুল ইসলাম। তবে এবারও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তবুও বিচারের আশায় পরিবার
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশা করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তবে সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, ‘যেহেতু এখন আর শেখ হাসিনা সরকার নেই, তাই আশা করছি এই সরকারের সময় হত্যার বিচার পাবো। অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয়। আমি তো প্রফেসর ইউনূস সাহেবের কাছে ন্যায়বিচারের আবেদন করেছি।’ আর রুনির ভাই নওশের রোমান বলেছেন, ’পিবিআই এর তদন্তকারীরা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা নতুন করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তদন্তে নতুন কোনো অগ্রগতি আছে বলে তারা আমাদের জানাননি। তবুও আমরা আশাবাদী যেহেতু নতুনভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে৷’
বিচারের দিকে তাকিয়ে সাগর-রুনির সহকর্মীরা
এদিকে স্বজনদের পাশাপাশি প্রয়াত সাগর-রুনির সহকর্মী সাংবাদিকরাও অপেক্ষা করছেন বিচারের। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্মরণে প্রতিবছর কর্মসূচি পালন করেন। এবছরও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
এদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। ডিআরইউর পক্ষ থেকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্মারকলিপিও দেয়া হয়।
ওই বিক্ষোভ সমাবেশে ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকন বলেন, ‘সবাই সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই। কিন্তু গত ১৩ বছরেও এই হত্যার বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার যে ফ্যাসিস্ট ছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে, এই হত্যার বিচারকে তারা ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত ছিল। আমরা বিচারের দাবিতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে রাস্তায় নামব এবং জোরালোভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
ওই সমাবেশ থেকে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের দিনটি সাংবাদিক সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানান সাংবাদিকরা।

