২৩ টি গন্তব্যের মধ্যে লাভে মাত্র ১১টি
ঢাকা ম্যানচেস্টার প্রতি ফ্লাইটে লোকসান ১ কোটি ১০ লাখ
নিট লাভ-লস নিয়ে লুকোচুরি
২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আয় হবে ১০ হাজার কোটি টাকা : বিমান এমডি
আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালিয়ে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনকে। সংস্থাটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক রুটের ২৩টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
বিমানের তথ্য মতে, এর মধ্যে ১১টি রুটে লাভ হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে, ঢাকা থেকে লন্ডন, টরেন্টো, দুবাই, জেদ্দা, মদিনা, রিয়াদ, দাম্মাম, ব্যাংকক, কাঠমান্ডু, কুয়ালালামপুর ও সিঙ্গাপুর। ৬টি রুটে লোকসান হচ্ছে। সেগুলো হচ্ছে, ম্যানচেস্টার, কুয়েত, দিল্লি, কলকাতা, গুয়াংজু ও নারিতা। এ ছাড়া এক্সেস ব্যাগেজের ওজন সমন্বয় করে চারটি রুট লাভে আনার চেষ্টা হচ্ছে। সেগুলো হলো, আবুধাবি, মাসকাট, দোহা ও শারজাহ।
শুধুমাত্র ঢাকা-ম্যানচেস্টার রুটে প্রতিটি ফ্লাইটে লোকসান গুনতে হচ্ছে ১ কোটি ১০ লাখ। গত এক বছর এই রুটে বিমান লোকসান দিয়েছে ১৮৭ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসেই লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৭২ কোটি টাকা। এছাড়া নারিতা রুটেও ফ্লাইট প্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় কোটি টাকার মতো। ১ বছরে এই ৬ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবার শঙ্কা করছেন সংশ্লিস্টরা। এছাড়া রোম ও চেন্নাই রুটের বিষয় কোনো তথ্য দেয় নি সংস্থাটি। সে হিসেবে অর্ধেকের বেশি রুটে ফ্লাইট চালিয়ে লাভের মুখ দেখছে না বিমান। এছাড়া বিমানের বার্ষিক লাভ-ক্ষতির হিসাব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গেল সপ্তাহে জাতীয় সংসদে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিমানের দেওয়া প্রতিবেদন ও সংশ্লিস্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
যদিও বিমানের দাবী গত কয়েক বছর ধরেই তারা লাভে আছে। গত অর্থ বছরে (২০২২-২০২৩) বিমান ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এই বছরও(২০২৩-২০২৪) ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হবে। শুধ কার্গো থেকেই ১২শ কোটি টাকা লাভ হবে।
সংসদীয় কমিটিতে দেয়া বিমানের তথ্যানুযায়ী, সংস্থাটিকে লাভজনক করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিমান। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে ওই প্রতিবেদেনে বলা হয়, অনটাইম পারফরম্যান্সের ওপর গুরুত্বারোপ, যাত্রীপ্রতি রাজস্ব বৃদ্ধির ও ব্যয় সংকোচনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া, বোয়িং কোম্পানি থেকে নেওয়া নতুন উড়োজাহাজের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। যাত্রীসেবার মানে দৃশ্যমান উন্নয়ন করা হয়েছে। যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা অক্ষুণ্ন রয়েছে। ভাড়ার সঙ্গে অ্যাকসেস ব্যাগেজের ওয়েট সমন্বয়পূর্বক লোড পেনাল্টি পরিহারের প্রক্রিয়া চলছে। দোহা, আবুধাবি, শারজাহ ও মাসকাট রুট লাভজনক করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ককপিট ক্র নিয়োগ প্রকিয়া চলমান রয়েছে।
প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ থেকে ২০৩৫ অর্থবছররের পরিকল্পনানুযায়ি লাভজনক রুটে ফ্লাইট বাড়ানো এবং নতুন গন্তব্যে ফ্লাইট চালানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। নতুন আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে মালে, কুনমিং, সিডনি, জাকার্তা, সিউল, উহান ও বাহরাইন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নিউইয়র্কে পুনরায় ফ্লাইট পরিচালনার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে নতুন ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য গন্তব্যগুলো চট্টগ্রাম-যশোর, চট্টগ্রাম-সিলেট এবং ঢাকা-যশোর-কক্সবাজার এবং ঢাকা-বরিশাল-কক্সবাজার।
জানা গেছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লোকসানে থাকলেও লাভজনক দেখাতে কৌশলের আশ্রয় নেয়। এজন্য তারা সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের লাভের অর্থ যুক্ত করেছে। দায়ের তথ্য গোপন করা হয়েছে। ভ্যাট-ট্যাক্স ও সুদ বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা বকেয়া থাকলেও তা হিসাবে দেখায়না।
গত মে মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির কাছে বিমানের পাঁচ বছরের আয়-ব্যয় হিসাববিষয়ক প্রতিবেদন জমা দেয় বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
অডিট অধিদপ্তরের মতামতে বলা হয়, ‘হিসাবে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্স (বিপিসি) ও বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারের (বিএফসিসি) অর্জিত নিট লাভ যোগ করেছে। ফলে বিমান নিট লাভ দেখালেও ২০২০ সালে ১০২ কোটি ৯৯ লাখ ৯৩ হাজার ৮৩৭ টাকা এবং ২০২৩ সালে ২৫ কোটি ৯১ লাখ ৮ হাজার ২৭৮ টাকা নিট ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছে না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিমান ২০১৭-২৩ সাল পর্যন্ত ভ্যালুয়েশনের দায়গুলো দেখায়নি। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে ল্যান্ডিংসহ বিভিন্ন চার্জের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ বিপুল টাকা বকেয়া থাকলেও গত ৫ বছরের হিসাবে তা দায় হিসেবে দেখানো হয়নি। এ ছাড়াও পদ্মা অয়েলের কাছে বিলম্বিত জ্বালানির মূল্য পরিশোধের সুদ বাবদ বড় অঙ্কের টাকা বাকি থাকলেও তা দেখানো হয়নি। ২০২১ সালে ৬২২ কোটি ২০ লাখ ৫২ হাজার টাকা কম দেখানো হয়। পেনশন ও গ্র্যাচুইটির বিপরীতে প্রভিশন যথাযথভাবে প্রতিবছর রাখলে নিট লাভ কম হতো বা নিট লস হতো। এ ছাড়া গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিসেবা খাতের আয় এয়ারলাইন্স ব্যবসা-বহির্ভূত হলেও তা বিমানের আয় দেখানো হয়।
বিমানের কর্মকর্তারা বলছেন, নানা বিষয়ে বিমানে কৃচ্ছ্রসাধন করছে। কিন্তু ঢাকা ম্যানচেস্টার রুটে লাগামহীন লোকসান দিচ্ছে। এই রুটে ফ্লাই করলেই লোকসান হচ্ছে।
গত ১৩ জুন অনুষ্ঠিত বিমানের বৈঠকে পর্ষদ সদস্যরা ম্যানচেস্টার রুটে লোকসান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বৈঠকে বলা হয়, সব রুটের লাভক্ষতি নিয়ে বিমানের একটি পূর্ণাঙ্গ স্টাডি থাকা দরকার। যেসব রুটে লোকসান দিচ্ছে, সেসব রুটের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করতে হবে।
লোকসানি রুট বন্ধ বা চালু রাখার বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার জন্য পরিচালক (মার্কেটিং) নেতৃত্বে কমিটি করে ১৪ কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানায়, যে সব রুটে নিয়মিত লোকসান হচ্ছে সেসব রুটে ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিমান। পাশাপাশি যে সব রুট লাভবান সেসব রুটে ফ্লাইট বাড়ানো হবে। কিন্তু উড়োজাহাজ স্বল্পতার কারনে তা করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
গেল মে মাসে বিদায়ের আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) মো. শফিউল আজিম সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমান গত ১০ বছরের আট বছরই লাভে ছিল। গত ১০ বছরের মধ্যে যে দুই বছর লস হয়েছে, তার মধ্যে একবছর করোনাভাইরাসের আধিক্য ছিল। আরেকবার আমাদের মোটা অংকের পেমেন্ট পরিশোধ করতে হয়েছিল। গত বছর ডলারের সমস্যা ছিল, বিশ্বে দুটি যুদ্ধ চলমান, এর মধ্যেও আমরা লাভ করেছি। বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করা হয়েছে লাভের বিষয়ে। আমরা বিমানে নিয়মিত নিয়োগ দিচ্ছি, বেতন বোনাস দিচ্ছি, প্রোফিট বোনাস দিচ্ছি। লাভ না হলে এসব টাকা কোথা থেকে আসছে? যারা বলে বিমান লাভে নেই, আমি একটা কথাই বলব- আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত দান করুক।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. জাহিদুল ইসলাম ভুঞাকে।সাংবাদিকদের কাছে দাবী করেছেন, গত অর্থ বছরে (২০২২-২০২৩) বিমান ১০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এই বছরও(২০২৩-২০২৪) ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হবে। শুধ কার্গো থেকেই ১২শ কোটি টাকা লাভ কর।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, বিমানের প্রফিট-লস সিএ ফার্ম দিয়ে নির্ণয় করা হয়। এছাড়া পেট্রোবাংলার বিপিসিতে আমরা নিয়মিত পেমেন্ট করে যাচ্ছি। আর বকেয়া কমানোর প্রক্রিয়া অন গোয়িং আছে। গত ৩ বছর ধরে বিমান লাভে আছে। এ বছর ও লাভে থাকবে। যেসব রুটে লোকসান হচ্ছে সেগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং লাভজনক রুটে ফ্লাইট বাড়ানোর কাজ চলছে। কারেন্সির(মূল্যস্ফীতি) জন্য হাজার কোটি টাকার উপরে লস হবে না হলে গুড হেলদি পজিশনে থাকতাম। কস্ট মিনিমাইজেশন করার চেস্টা করছি।
বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য মাহমুদ হাসান বলেছেন, বিমানের যে সব রুট লাভজনক নয়, সেসব রুট লাভজনক করতে নতুন কর্মপরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রুটের সেবার মান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
রফিক রাফি

