‌’কখনো ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন আপনার ঘর-বাড়ি-উঠান পানিতে থৈ-থৈ করছে। আপনার গরু-ছাগল কিংবা হাঁস-মুরগী পানিতে ভেসে যাচ্ছে। যে ফসল দিয়ে আপনি পুরো বছরের খরচ চালাবেন সেই ফসল পানির নীচে, কেমন লাগবে’ এই প্রতিবেদককে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে পুতুল রানী নামের একজন বলতে থাকেন- ‘ধান ঘরে তুলেছেন কিন্তু উঠান ভর্তি পানির জন্য সেদ্ধ করে শুকনা করতে পারছেন না, ছোট্ট বাচ্চাটা কখন চোখের আড়ালে গিয়ে একেবারেই চিরতরে আড়ালে চলে গেছে, অবোধ পশু গরু ছাগলের খাবার দিতে পারছেন না, পানি চলে গেছে তারপর কি করবেন দিশাহারা হয়ে মহাজনি সুদের ঋনে দিগ্বিদিকশূন্য হওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এই এলাকার মানুষ। চোখের সামনে স্বপ্ন ডুবে যেতে দেখার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে অনেকেরই বলে জানান এই পুতুল রানী।

গাইবান্ধার সাঘাটার চিনির পটল জোলা পারার বাসিন্দা পুতুল রানীর বাবা দাদারা প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করতে করতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ২০১৯ সালে পুতুল ঘরে ধান তুলতে পারেন নাই হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার কারণে। সেই সময়ের কষ্টের কথা তিনি আজো ভুলতে পারেন নাই বলে জানান।

প্রতিবছরই এই এলাকায় বন্যা হয় প্রতিবছরই নানা রকম নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে নিকটসময়ের মধ্যে ২০১৯ সালের বন্যা ছিলো ভয়াবহ। সেবার গ্রামের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতারাতি পানিতে ডুবে যায় গাইবান্ধার নিম্নাঞ্চল। ডুবে যায় রাস্তা পথ-ঘাট, বসত-ভিটাসহ আবাদি জমি। অনেকেই ফসল ঘরে তুলতে পারেন নাই। সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনো এই এলাকার মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে গাইবান্ধার সাঘাটার চিনির পটল গ্রামের ঝুমি বেগম বলেন, ‘আগোত (আগে) হামরা (আমরা) কোনো কূল কিনারা কিছুই পাঙ (পাই) নাই। বন্যার পানি আসা শুরু হইলে হামার জান ধুকুর-পুকুর করা শুরু করে। এলা (এখন) আর ওদান (ওরকম) না হয়। এখন হামরা বন্যা কন আর ঝড়-বিষ্টি (বৃষ্টি) যেটাই কন, আসার আগে জানবার পাই। গরু ছাগল হাস মুরগী সরাবার পাই। জমিত ধান থাকলে কি করা নাগবে সেটা করবার পাই। এখন তো আগোতে ম্যাসেজ দিয়া দেয়।’

‘কোনো দিন চিন্তাও করবার পাঙ নাই একটা মেসেজ হামারঘরোক (আমাদেরকে) এতো বাঁচে দিবে। হামরা এখন পানি ঢুকপার আগোতে বুঝবার পাই।’

তার কথা কেড়ে নিয়ে আরেকজন বলে ওঠেন, ‘খালি পানি ওঠা নোওয়ায় (নয়)। হামরা এখন সোউগে (সব) আগে থাকি জানবার পাই। বিজলি চমকালে কি করা লাগবে, পানি বাড়লে কেমন করি রাস্তা ঠিকঠাক রাখা যাইবে, আরো কতো কি যে শিখছি এই ২ বছর। যখন ছোট আছিলাম, হায়রে কষ্ট কচ্ছি (করেছি)।

এভাবেই নিজেদের কষ্ট আর ভালোলাগা বলছিলেন গাইবান্ধা শহর থেকে ৮ মাইল দুরে সাঘাটা ইউনিয়নের ঝুমঝুমি বেগম, লতিফা বানু, শিল্পী বেগম, পুতুল রানী, আব্দুর রাজ্জাক, সাবিনা বেগম, সোনালী রানীসহ অনেকেই।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ভৌগোলিক অবস্থান এবং দুর্বল অবকাঠামোর কারণে এই দেশে প্রায় প্রতিবছর কোন না কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে- যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদী ভাঙ্গন, খরা, বজ্রপাত ও জলোচ্ছ্বাস। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র জনগণ এই দুর্যোগগুলো সরাসরি ও ভয়াবহভাবে দূর্যোগের প্রভাব বহন করে থাকে।

আর এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া এক সাহসী জেলার নাম গাইবান্ধা। এই জেলার মানুষ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে বন্যা, খরা, দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়েছে তা এক সংগ্রামী ইতিহাস।

অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সঠিক প্রস্তুতির অভাব এবং সরকারি, বেসরকারি সহায়তার সীমাবদ্ধতা এই সংকটকে আরো বাড়িয়ে দেয় বলে জানান গাইবান্ধার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসকেএস ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক খন্দকার জাহিদ সারওয়ার।

জাহিদ সারওয়ার কেয়ার বাংলাদেশের সহায়তায় পরিচালিত সুফল (২) প্রকল্পের ফোকাল পারসন হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এই লড়াইয়ে জিততে হলে দরকার একটা সম্মিলিত, পরিকল্পিত, মানবিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো।

তার মতে, দূর্যোগ প্রবণ এলাকায় দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের জন্য আলাদা কৌশল প্রয়োগ করা খুবই জরুরি । দুর্যোগ শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তারও পরীক্ষা। পরিকল্পনা, সচেতনতা এবং আন্তরিক উদ্যোগের মাধ্যমে দুর্যোগের প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা যেতে পারে বলেও জানান তিনি।

অতীতে উত্তরাঞ্চলের মানুষ মঙ্গা, বন্যা, দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে যেভাবে জর্জরিত ছিলো এখন আর তা নেই। মঙ্গা এখন অতীত। বন্যায়ও এখন আর মানুষ আগের মতো ক্ষয় ক্ষতির শিকার হন না। এর পিছনের কারণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা বলে জানান এলাকার মানুষ।

সুফল- ২ প্রকল্পের সহকারী ম্যানেজার মোছা. কামরুন নাহার বলেন, ‘অনেক আগের কথা নয়। মাত্র ৬ বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের কথা। হঠাৎ বন্যা হওয়ায় গাইবান্ধার অনেক গ্রামের বিশেষ করে সাঘাটা ফুলছড়ি ইউনিয়নের অনেক কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারেন নাই। তুললেও সেদ্ধ করে শুকনা করতে না পারায় ধান ‘চিটা’ হয়ে নষ্ট হওয়ায় সেবার প্রচুর কষ্ট হয়েছিলো এই এলাকার মানুষের। কারণ ধান বেঁচেই মূলত তাদের সংসার চলে। সেই ধান যদি না থাকে তাহলে সংসার চালানো অত্যন্ত কষ্টের হয়ে যায়। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে নিম্ন আয়ের মানুষ।

নাহার বলেন, ২০১৯ সালে গাইবান্ধায় ভয়াবহ বন্যায় যখন গাইবান্ধার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও সদরসহ ৭ উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখন এই এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ শুরু করে কেয়ার বাংলাদেশ।

গাইবান্ধার এসকেএস ফাউন্ডেশনের মতো স্থানীয় কয়েকটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে শুরু করে ‘সুফল’ নামের প্রকল্প ।

সুফল প্রকল্পের প্রথম ফেইজে অর্থ, খাদ্যসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান কারলেও দ্বিতীয় ফেইজে পুরোদমে এলাকার নারী পুরুষদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ শুরু করে বলে জানান এসকেএস এর উপ-পরিচালক ও সুফল প্রকল্পের ফোকাল পারসন খন্দকার জাহিদ সরওয়ার।

এই প্রকল্পের উপকারভোগী চিনির পটল মাঝিপাড়ার সোনালী রানী বলেন, আমরা এখন শুধু নিজেরাই সচেতন হইছি তা কিন্তু নয়। আমরা অনেক ট্রেনিং করছি। ট্রেনিং থেকে যা শিখছি সেগুলা আবার এলাকার অন্য নারী-পুরুষদের সাথে আলোচনা করি।

আমাদের এলাকায় ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, বজ্রপাত অনেক হয়। মানুষ থেকে শুরু করে পশু পাখি মারাও যায়। আজ থেকে ৪/৫ বছর আগেও ঘরে ঘরে গবাদি পশু মারা গেছে, মানুষ মারা গেছে বন্যার পানিতে, বজ্রপাতে। এখন আর আগের মতো পশুপাখি মারা যায় না। মানুষ আগে আগে জানতে পারে কখন বৃষ্টি হবে। কতোটুকু বৃষ্টি হবে। বন্যার পানির অবস্থা কেমন। বিভিন্ন দূর্যোগের অবস্থা দেখে আমরা এখন সেই হিসাবে প্রস্তুতি নিতে পারি। বজ্রপাতের সময় কি করা লাগবে আমরা কিন্তু তাও শিখছি। সুফল প্রজেক্ট আমাদেরকে অনেক কিছু শিখাইছে। এই ধরনের প্রজেক্ট আরো বেশি বেশি থাকা দরকার বলে জানান এই নারী। সোনালী বলেন, আমাদের লেখাপড়া বেশি নাই। কিন্তু এই প্রজেক্ট থেকে এমন কিছু শিখছি যা আমাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে।

নুরুন নাহার এই প্রতিবেদককে বলেন, সুফল প্রজেক্ট আমাদের এলাকায় সুফল বয়ে এনেছে। আমি গাইবান্ধার সন্তান। গাইবান্ধা হলো প্রাকৃতিক দূর্যোগের আখড়া। ছোটবেলা থেকে এই এলাকার মানুষের জীবন যুদ্ধ দেখে হতাশ হয়ে যেতাম। নদী ভাঙন, বন্যায় হাঁস মুরগী গবাদিপশুই শুধু না মানুষও ভেসে যেতো। বজ্রপাতে মারা যাওয়ার হারও এই এলাকাতে অনেক বেশি ছিলো।

কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে এই এলাকার মানুষ। আর এই দুর্যোগ মোকাবেলায় পিছন থেকে যারা সাহস যুগিয়েছে তারা হলেন সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ।

সাঘাটার খামার পবন গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পাঁচ দশ বছর আগের সময়ের সাথে এখন অনেক পার্থক্য। আগে তো কিছুই জানা যাইতো না। ঝড় বৃষ্টি হইলে বিদ্যুৎ থাকতো না। রেডিও টিভি বন্ধ হয়ে যাইতো। এখন আগাম সতর্ক বার্তার জন্য টিভি রেডিও লাগে না। এখন ছোট্ট একটা মোবাইল থাকলেই যথেষ্ট। আর একজন জানলে পুরা গ্রাম জেনে যায়। মানুষ সতর্ক হইতে পারে।

শুধু বন্যার সময় যে শুধু সুফল প্রকল্প থেকে ভয়েস কল আসতো তা কিন্তু নয়। আমাদের বিভিন্ন এলাকায় সংগঠিত গ্রুপের সদস্যদের কাছে আবহাওয়ার খবরও দেওয়া হতো। যেমন জমিতে কোন আবহাওয়ায় সেচ, কীটনাশক বা কোন সার দিতে হবে আর কখন প্রয়োগ করা যাবে না, সে সম্পর্কেও ভয়েস কলে খবর আসতো। সারের পাশাপাশি শৈত্য প্রবাহ ও খরার আগাম বার্তা এবং কোন মৌসুমে কোন ফসল আর কোন ধরনের বীজ বপন করতে হবে সে বিষয়ে জানিয়ে দিতো ভয়েস কলে।

এই ভয়েস কলের ওপর আমাদের আস্থা ছিলো শতভাগ। আমরা অপেক্ষা করতাম এই ভয়েস কলের জন্য। এখন কি হবে জানিনা। আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি কেয়ার বাংলাদেশ, এসকেএস ও এই কার্যক্রমের সকল কর্মকর্তাদের বলতে চাই প্রজেক্ট শেষ হচ্ছে হোক। কিন্তু আমাদের ছেড়ে না যাবেন না। এই এলাকার মানুষ বড়ো অসহায়। যে সুবিধা পাইছি গত ২ বছর তা যেন পাইতেই থাকি। আবহাওয়ার আগাম সতর্ক বার্তা আমাদেরমতো কৃষকদের বেঁচে থাকার ঢাল।

জাহিদা পারভেজ ছন্দা