সীমিত রাজস্ব পদ, দ্রুত জনবল নিয়োগের প্রয়োজন এবং প্রকল্পভিত্তিক কাজের সুবিধা- সব মিলিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় অংশেই আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ এখন নিত্যদিনের বিষয়। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতা ভিন্ন। কয়েক বছর ধরে এই ব্যবস্থায় যুক্ত হাজার হাজার তরুণের জীবনে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, যা অনেকের মতে এখন ’আউটসোর্সিং ফাঁদ’ -এ পরিণত হয়েছে।

সরকারি দপ্তরগুলোতে আউটসোর্সিং বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দীর্ঘদিন ধরেই একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রকল্পে শুরু, প্রকল্পেই শেষ
২০০০ সালের পর থেকে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এমনকি স্থানীয় সরকার- সবখানেই প্রচুর আউটসোর্সিং কর্মী নেওয়া হয়েছে। সাধারণত ১ থেকে ৩ বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, প্রয়োজন হলে নবায়ন করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো- প্রকল্প শেষ হলে কর্মীদের অধিকাংশই আর কোনো কাজ পান না। পাঁচ বছর, কখনও সাত বছর- একই দপ্তরে কাজ করেও তারা থাকেন ’অস্থায়ী’ কর্মী হিসেবেই। পদ তৈরি হয় না, স্থায়ীকরণ হয় না, এমনকি অভিজ্ঞতার মূল্যায়নেরও কোনো কাঠামো নেই। সরকারি চাকরির মতো পেনশন, স্থায়ী বেতনগ্রেড বা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা- কিছুই মেলে না। ফলে প্রকল্প শেষ হওয়ার মুহূর্তে তারা কার্যত বেকারের কাতারেই দাঁড়িয়ে যান।
অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ নেই
বাংলাদেশে অপ্রতুল কর্মসংস্থানের কারণে অনেকেই আউটসোর্সিং চাকরিকে প্রথমে ‘এন্ট্রি-পয়েন্ট’ ভেবে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন- কয়েক বছর কাজ করলে অভিজ্ঞতা দেখে সরকার স্থায়ী চাকরির সুযোগ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেশের কোনো কেন্দ্রীয় নীতিতেই এখনো স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই যে, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি দপ্তরে সেবা দেওয়া আউটসোর্সিং কর্মীদের জন্য রাজস্ব খাতে স্থানান্তর, অগ্রাধিকার নিয়োগ বা দক্ষতা-স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ফলে অসংখ্য দক্ষ তরুণ আজ চাকরি হারানোর ভয় নিয়ে প্রতিদিন কাজ করেন। তাদের কেউ কেউ ৩০-৩৫ বছর বয়সে এসে আবার শ্রমবাজারে নতুন করে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হচ্ছেন- যা বাস্তবিকই অসম্ভব প্রায়।
সামাজিক ও মানসিক চাপ
চাকরির অনিশ্চয়তা শুধু আর্থিক সমস্যা তৈরি করছে না- একটি বড় সামাজিক সংকটের সূত্রপাত করছে। অনেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরিবার চালাচ্ছেন- প্রকল্প শেষ হলে সে ঋণের বোঝা বাড়ছে। পরিবার-গঠন, সন্তান-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা- সবকিছুতেই তৈরি হচ্ছে অজানা শঙ্কা। দীর্ঘদিন একই অফিসে কাজ করেও নিজের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা না থাকায় অনেক তরুণ মানসিক চাপে ভুগছেন।
এক কর্মীর ভাষায়, ‘চাকরি আছে কিংবা নেই- প্রতিবার কনট্রাক্ট নবায়নের সময় একই ভয়। অথচ একই ডেস্কে বসে স্থায়ী কর্মীর সঙ্গে সমান কাজ করি।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পাসপোর্ট এন্ড ইমিগ্রেশন অফিসের এক অফিস সহকারীর বক্তব্যে জানা যায় যে, আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পাঁচ বছর চাকরি করার পরে তার কন্ট্রাক্ট আর রিনিউ হয়নি বলে তার সংসারের ব্যায়ভার বহনে অপারগ হয়ে একই অফিসে দালালি করে দু’মুঠো অন্ন যোগানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেটি তার জন্য অসহনীয় মানসিক চাপ বলে তিনি জানান।
সরকারের কিছু উদ্যোগ আছে, কিন্তু যথেষ্ট নয়
২০২৫ সালের এপ্রিলে সরকার আউটসোর্সিং কর্মীদের সার্ভিস ফি বৃদ্ধি, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো কিছু সুবিধা যুক্ত করে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ- কিন্তু এই নীতিমালা ‘স্থায়ী চাকরির বৈধতা’ বা ‘প্রকল্প শেষে কর্মীর ভবিষ্যৎ’- দুটোরই সমাধান দেয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই খাতে কর্মরত অভিজ্ঞদের ডাটাবেইজ তৈরি করা। যারা ৩-৫ বছর বা তার বেশি সেবা দিয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং দক্ষতা সার্টিফিকেশন দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া রাজস্বখাতে নির্দিষ্ট ‘ট্রানজিশন পাথওয়ে’ না থাকলে আউটসোর্সিং ফাঁদ থেকে কেউই বেরোতে পারবেন না।
জাতীয় মানবসম্পদ অপচয়
বাংলাদেশে আইটি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ডেটা ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন- এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে বহু দক্ষ কর্মী বছরের পর বছর শ্রম দিচ্ছেন।
কিন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন তারা কর্মহীন হয়ে পড়েন- তখন দেশও তাদের দক্ষতাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে না।
একে বলা যায় ‘মানবসম্পদের অপচয়’, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের প্রশাসনিক সক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সমাধানের পথ

বাংলাদেশ আউটসোর্সিং কর্মচারী ঐক্যের সদস্যরা সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ, আউটসোর্সিং এবং দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান বন্ধ করা, এবং কর্মীদের জন্য চাকরির নিরাপত্তার দাবিতে ২০২৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং ‘ঠিকাদার দাসত্ব ব্যবস্থা’-র প্রতীক হিসেবে একটি কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। (ছবি: সংগৃহীত)।
নীতিনির্ধারকদের মতে তিনটি বড় সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যার সমাধান সহজ হবেঃ এক. ৩-৫ বছর বা তার বেশি সেবাদানকারী আউটসোর্সিং কর্মীদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ীকরণ বা রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি। দুই. সকল আউটসোর্সিং কর্মীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের একটি জাতীয় মূল্যায়ন ব্যবস্থা। তিন. প্রকল্প শেষে কর্মীদের জন্য পুনর্বাসন বা পুনঃনিয়োগ সাপোর্ট- যেমন ট্রানজিশন ফান্ড বা নতুন প্রজেক্টে অগ্রাধিকার।
উপসংহার
বাংলাদেশের বৃহৎ যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ আজ আউটসোর্সিং ব্যবস্থার কারণে অদৃশ্য সংকটে ভুগছে। তারা দেশের সেবায় নিজেদের দক্ষতা ও জীবন দিচ্ছেন, কিন্তু তার বিনিময়ে পাচ্ছেন কেবল অনিশ্চয়তা। আউটসোর্সিং হতে পারে দ্রুত নিয়োগের কার্যকর পদ্ধতি- কিন্তু এর মাধ্যমে ‘যুবশক্তিকে ঝুলিয়ে রাখা’ কোনোভাবেই টেকসই উন্নয়ন নয়।
যুব সমাজের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে আউটসোর্সিং কর্মীদের জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা, দক্ষতার স্বীকৃতি এবং চাকরির নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করা এখনই সময়ের দাবি।

