বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ সবচেয়ে বড় যে সংকটটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- তা হলো আস্থার সংকট। জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি, নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নৈতিকতা- এই তিন ক্ষেত্রেই গভীর হতাশা অনুভব করছে।
অথচ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতির মূল শক্তিই হচ্ছে জনআস্থা। এই শক্তি ক্ষয়ে গেলে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেওয়ার সব পথই ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে।
দলীয় রাজনীতি ও জনমানসের দূরত্বঃ
বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো- রাজনৈতিক দলগুলো নীতি-নৈতিকতার চেয়ে কৌশল ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের সমস্যা, যেমন- চাকরি, জীবনযাত্রার ব্যয়, কৃষকের সংকট, শিক্ষার গুণগত মান- এসব বিষয়ে দেশের রাজনীতিতে নীতিনির্ভর আলোচনা ক্রমেই কমে এসেছে। ফলে সাধারণ মানুষ মনে করে- দেশের রাজনীতি এখন তাদের আর তাদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং কিছু গোষ্ঠীর ক্ষমতার লড়াইয়ের সাথে বেশি সম্পর্কিত।
সংলাপের অভাব ও সংঘাতের রাজনীতিঃ
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে- যেখানে ভিন্নমতকে প্রতিপক্ষ নয়, প্রায়শই শত্রু বলে ভাবা হয়। রাজনীতিতে সংলাপ, আপস কিংবা সমঝোতার যেসব ঐতিহ্য ছিল- তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। অথচ যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে পারস্পরিক আলোচনা কিংবা কথা বলার সংস্কৃতি- এটাই রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। সংলাপের অনুপস্থিতিতে জন্ম নেয় বিভাজন, আর বিভাজন থেকে আসে সংঘাত।
নবপ্রজন্ম ও রাজনৈতিক প্রত্যাশাঃ
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম পুরোনো রাজনৈতিক ভাষা আর প্রচলিত নেতৃত্বের ধরণে একেবারেই সন্তুষ্ট নয়। তারা চায়- স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিনির্ভর সেবা, পরিচ্ছন্ন প্রশাসন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে সুযোগ সৃষ্টি। এদের কাছে দেশ মানেই শুধু উন্নয়ন নয়। দেশ মানে ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। রাজনীতি যদি এই প্রত্যাশার সাথে তাল মেলাতে না পারে, তা’হলে ধীরে ধীরে রাজনীতির প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের অনীহা বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির সংস্কারের জন্য যা কিছু করা জরুরি, তার প্রথমটাই হচ্ছে- দলগুলোর ভিতরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করা, যেখানে নেতৃত্বের স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে হবে। নীতিনির্ভর রাজনীতির প্রত্যাবর্তনে শুধু স্লোগান নয়- বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। রাজনীতিতে সংলাপের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। বিরোধিতা মানেই শত্রুতা নয়- এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধাচরণে রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রয়োগে ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় বিবেচনা করলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই এই বিষয়ে সর্বাত্বক রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকতে হবে। সর্বোপরী, নবপ্রজন্মকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে নতুন উদ্ভাবনী ও চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। কারন, যুগের চাহিদায় নতুন নেতৃত্ব ছাড়া রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জাতির উন্নত ভবিষ্যৎ অসম্ভব।
পরিশেষে, রাজনীতি কোনো বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র নয়- এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। তাই বিদ্যমান রাজনীতির মান উন্নয়ন করা মানেই- আমাদের ভবিষ্যতের মান উন্নয়ন করা। এখন প্রয়োজন ব্যক্তি, দল এবং রাষ্ট্র- সবার সম্মিলিত প্রয়াসে আস্থা পুনর্গঠন। আস্থাই হবে আগামী দিনের রাজনীতির মূল পুঁজি।

