আবারো জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে আসলো বাংলাদেশে। বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে রায় ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ এই রায় ঘোষণা করেন। আদালত জানিয়েছে, চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন (১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে সব নির্বাচন নিয়ে বিচ্ছিন্ন সমালোচনা থাকলেও, ভোটে কারচুপি বা ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ওঠেনি। আর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে।

এরপর গত এক যুগ আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। ফলে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে বাদ পড়ে নির্বাচনকালীন এই সরকারব্যবস্থা। এরপর বাংলাদেশে যে তিনটি জাতীয় অনুষ্ঠিত নির্বাচন হয়, তার সব কটিই বিতর্কে পড়ে। এই তিনটি জাতীয় নির্বাচন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের কারণেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে দিয়ে রায় ঘোষনাকারী আপিল বিভাগের অপর ছয় সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ১৪ বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। বাকিরা হলোন- তোফায়েল আহমেদ, এম. হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভুঁইয়া ও জাহরা রহমান।

রায় ঘোষণার পর, রিট আবেদনকারী এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের সামনে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন।

এরপর রিভিউ আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরেকটি রিভিউ আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন রায় নিয়ে আরেকটি আবেদন করেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠনও রিভিউ আবেদন করে। এ ছাড়া সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে এ মামলায় যুক্ত হয়।

রিভিউ আবেদনের শুনানির পর গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপি মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে গত ২১ অক্টোবর থেকে শুনানি শুরু হয়। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দশম দিনে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন।

শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে দিয়ে সাময়িক সমাধান দিতে চায় না আপিল বিভাগ। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কার্যকর সমাধান চায় আপিল বিভাগ। যাতে এটি বারবার বিঘ্নিত না হয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এটি যাতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখে, সেটিই করা হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে দিলে তা কখন থেকে কার্যকর হবে- শুনানীকালে সে প্রশ্নও রেখেছিলেন প্রধান বিচারপতি। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, গেলো দেড় দশকে দেশের মানুষ শাসিতের পরিবর্তে শোষিত হয়েছে নানাভাবে। মানুষ গুম খুন বিচার বহির্ভূত হত্যা ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব সিস্টেম ছিল সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং মানুষ বিচার পায়নি। যার কারণে এই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। আর সেই রাজপথ থেকেই নির্ধারিত হয়েছে কে প্রধান বিচারপতি হবেন আর কে সরকার প্রধান হবেন। জনগণের এই ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। এসব অবজ্ঞা করলেই বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি দেন আপিল বিভাগ।

প্রসঙ্গত, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে অ্যাডভোকেট এম. সলিম উল্লাহসহ তিনজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। তবে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষে রিটটি খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়। আদালত এ মামলায় আট জন অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করে তাদের মতামত শোনেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন।

তারা হলেন- ড. কামাল হোসেন, টিএইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। অপর অ্যামিকাস কিউরি ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মত দেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক ও ড. এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে মত দিয়ে তাদের প্রস্তাব আদালতে তুলে ধরেন। এছাড়া তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন।

এরপর আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়।

বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয় নির্বাচনকালীন সময়ে আবারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে আসলো ।

অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান মন্তব্য করেছেন যে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ায় দেশ এখন গণতন্ত্রের মহাসড়কে চলতে শুরু করবে।’ তিনি বলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো দেশে ‘গণতন্ত্রের কবর’ রচনা করেছিল। তিনি আরও যোগ করেন, দেশের মানুষ এখন ভবিষ্যতে তাদের নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে।