বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের নজিরবিহীন অবনতি ঘটেছে। দুই দেশের জনগণ এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে পারস্পারিক দোষারোপের সংস্কৃতি- এই সম্পর্ককে আরো শীতল করে তুলেছে। ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গত ২২ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ এবং ভারত- দুই দেশই ঘোষণা দিয়ে তাদের নিয়মিত ভিসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবেশী দুই দেশের পরস্পর বিরোধী উত্তেজনা এখন এই অঞ্চলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

উল্লেখ্য, গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব শৈত্যপ্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে শুরু হওয়া এই অস্থিরতা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে।

বাংলাদেশে গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যকার প্রতিবেশী সুলভ ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কে ব্যাপক টানাপোড়েন শুরু হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা এবং ইসকন প্রবর্তক শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ভারতের পক্ষ থেকে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশেও ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়।

এদিকে, গত ১২ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি ঢাকায় দুর্বৃত্তের ছোঁড়া গুলিতে মাথায় মারাত্মকভাবে আহত হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে মারা যান।

এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাদিকে আক্রমণ করা ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসী’ ঘটনার পরপর বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিরাপদে সীমান্ত পার হয়ে ভারত পালিয়ে গেছে- এই মর্মে ছবি প্রকাশ হলে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ এবং ক্ষোভের সঞ্চার হয়।

হাদির ঘটনায় গত ১৭ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঐক্য’ নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন অভিমুখে লংমার্চ ও স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি পালিত হয়। এসব কর্মসূচি থেকে ভারতের বর্তমান অবস্থানের কড়া সমালোচনা করা হয়।

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ও পরবর্তীতে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে গত ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশান এলাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে পদযাত্রা করার সময় একদল বিক্ষোভকারীকে বাধা দিয়েছে পুলিশ।

এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে এবং কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাই কমিশনের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী ও নাগরিক সংগঠন।

ভারতের বিক্ষোভগুলোতে বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও স্লোগান দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিবাদে সমাবেশ চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশে হিন্দু যুবক দিপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে গত ২২ ডিসেম্বর দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে শত শত মানুষ জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন।

তৃণমূল পর্যায়ে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও ‘টিট-ফর-ট্যাট’ বা পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

নিকট অতীতে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ প্রণয় ভার্মাকে তলব করে প্রথম দফায় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে হামলা ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ‘অপপ্রচার’ নিয়ে প্রতিবাদ জানায়। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ভারতীয় স্থাপনার সুরক্ষা দাবি জানায়।

সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারত সরকার বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে বার বার উদ্বেগ জানিয়ে আসছে, যা ঢাকা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রচুর গুজব ও উস্কানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে।

বর্তমানে ভারত থেকে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে ভারত ভ্রমণের জন্য সাধারণ ভিসা ইস্যু কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাধারণ নাগরিকরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই একে অপরকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রাখার এবং একে অপরের ভূখণ্ডে থাকা কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে জনস্তরের ক্ষোভ এবং রাজনৈতিক বয়ান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক হতে সময় নিচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা- দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক অপরিহার্য। বর্তমানে দুই দেশই একটি ‘অপেক্ষা করো এবং দেখো’ (Wait and Watch) নীতি অবলম্বন করছে।